মোহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহ (খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা প্রতিনিধি) :
বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসব । এ সময় নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারা দেশ।
বর্ণিল-আলোঝলমলে, হইচইয়ে ভরা কাউন্টডাউন আর আতশবাজিতে উদ্দাম আনন্দ উদযাপনের দৃশ্য ফুটে উঠে দেশব্যাপী। পান্তাভাত, শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, খেলাধুলা, খাবার দাবার, নাচ-গান ও ঘুরে বেড়ানো – আরো কত্তো কী !
সারাদেশে একই নিয়মে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হলেও ঢাকা শহর ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নববর্ষ উদযাপন হয় ভিন্ন আবহে। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামে নববর্ষ উদযাপন হয় একেবারে ভিন্ন মাত্রায় ও স্বাদে।দেশবিদেশের অনেকেই এখান নববর্ষ উদযাপনের জন্য মুখিয়ে থাকেন।
উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনপদ খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান জেলায় ১৯৮৫ সাল থেকে
চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগে বৈসাবি উৎসব পালন হয়ে আসছে।
এটি তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানও বটে । এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুক, বৈসু বা বাইসু , মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত। স্থানীয় বাঙালীরাও একাকার হয়ে মিশে যায় বৈচিত্রময় এ উৎসবে।
বৈসাবী নামকরনও করা হয়েছে এই তিনটি সম্প্রদায়ের উৎসবের প্রথম অক্ষর গুলো দিয়ে। বৈ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, সা শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং বি শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। এই তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো ‘বৈসাবি’।
তবে পাহাড়ের মানুষ বৈসাবি শব্দটি নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, বৈসাবি শব্দটি দিয়ে পাহাড়ের শুধু তিনটি সম্প্রদায়ের উৎসবকে বোঝায়। এরা হলো চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা। ফলে বাকি অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনের উৎসবের কথা বাদ পড়ে যাচ্ছে।
আজ ভোরে চেঙ্গি, ফেনী ও মাইনি নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও প্রাণের উৎসব বৈসাবি।এবার ফুল বিজুর মূল প্রার্থনা হচ্ছে, করোনার প্রকোপ থেকে মুক্তি লাভ করা। এছাড়াও পুরনো বছরের দুঃখ, গ্লানি ভুলে নতুন বছরে ভালো কিছু প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন পাহাড়িরা। পাহাড়ি সম্প্রদায়ের তরুণ – তরুণী ও কিশোর-কিশোরীরা গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে নদী ও খালে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুরনো বছরের গ্লানি মুছে নতুন বছরের শুভকামনায় নিজেদের পবিত্রতা কামনা করে।
উৎসবের দিনক্ষণ শুরু হয়ে গেলেও এখানে নেই উৎসবের রঙ। নেই বৈসাবি উৎসবের শোভাযাত্রা, ঐতিহ্যবাহী গড়িয়া নৃত্য কিংবা খাগড়াছড়ির পানখাইয়াপাড়ার বটতলার বর্ণিল জলকেলি উৎসব।
উৎসব আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, গেল বছর করোনা মহামারির কারণে পার্বত্য জনপদ ছিল উৎসববিহীন। মাঝখানে করোনার প্রকোপ কমলেও গেলবারের মতো এবারো মার্চের শেষদিকে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ দিন দিন বাড়তে থাকায় ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত সারাদেশে শুরু হয় লকডাউন। আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে আবারো সাত দিনের জন্য ‘কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছেন সরকার। ফলে,পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব বৈসাবি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়।
লকডাউন জনিত আর্থিক লোকসান ও পরপর দুবার উৎসব উদযাপন না করতে পারার মনোবেদনায় মুখের হাসি শুকিয়ে যায় পার্বত্য এ জনপদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষগুলোর। হাসি নেই
কারো মুখে । উৎসব কিংবা হইচইয়ে মেতে উঠবেনা কোনো পাহাড়ি পাড়া মহল্লা।
ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ভার্চুয়ালি নববর্ষের অনুষ্ঠান করার ঘোষণা এসেছে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মনিরুল আলম বলেন, বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করেই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। করোনার এখন যে অবস্থা সেই অনুযায়ী নববর্ষ পালনের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জনসমাগম করা যাবে না, ভার্চুয়ালি যতটা করা যায়। সবার আগে আমাদের জনস্বার্থ দেখতে হবে।’
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য হিরন জয় ত্রিপুরা বলেন, করোনার কারণে গত বছর উৎসব পালন করতে পারিনি। এ বছরও করোনা পিছু ছাড়েনি। তবে এ মুহূর্তে উৎসব পালনের চেয়ে নিজেদের বেঁচে থাকাটাই জরুরি। তাই এ বছরও বৈসাবি উৎসবের কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকছে না।
গুইমারা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান উশ্যেপ্রু মারমা বলেন, মহামারি করোনা যেভাবে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তাতে করে এই মুহুর্তে উৎসবের চেয়ে জীবন বেশী মূল্যবান। তাই করোনা থেকে নিরাপদে থাকার লক্ষে আমরা এ বছরও উৎসব করা থেকে বিরত থাকবো। আগামীতে করোনার প্রকোপ কমে গেলে দ্বিগুণ আমেজে আমরা উৎসব পালন করবো।